লেখকঃ মুসাররাত খান
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের অবদান অনস্বীকার্য। এই খাত জাতীয় আয়, কর্মসংস্থান এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রথমে আমরা জেনে নিব, এসএমই কি?
SME হলো Small and Medium Enterprise যার বাংলা অর্থ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ। অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ব্যবসা, যেখানে কর্মচারীর সংখ্যা এবং পুঁজি পরিমাণ সীমিত সেগুলোকে বলা হয় ক্ষুদ্র উদ্যোগ। অন্যদিকে, তুলনামূলকভাবে বড় তবে এখনো কর্পোরেট কোম্পানি নয় সেগুলোকে বলা হয় মাঝারি উদ্যোগ।
দেশের প্রায় ৭৮ শতাংশ শিল্প এসএমই নির্ভর যা জিডিপিতে প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান রাখে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, কোভিড-১৯ পরবর্তী ধাক্কা এবং সরবরাহ চেইনের জটিলতার কারণে এসএমই খাত সংকটে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের কার্যকর নীতি এবং সহায়তা ছাড়া এই খাতকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
কেন এসএমই খাত গুরুত্বপূর্ণ?
এসএমই খাত এদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। এই খাত শুধু শহরেই নয়, গ্রামের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং নতুন উদ্যোক্তার সৃষ্টিতে এসএমই একটি শক্তিশালী মাধ্যম। তবুও সীমিত পুঁজি, ঋণ গ্রহণের জটিলতা, করের চাপ এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব এই খাতের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসএমই খাত দুর্বল হলে এর প্রভাব পড়বে জাতীয় উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি সম্ভাবনার ওপর। এ খাতকে সুরক্ষিত রাখতে এখন সরকারের উদ্যোগ অপরিহার্য।
এসএমই ব্যবসার প্রধান ক্যাটাগরি
এসএমই ব্যবসা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। সাধারণত বাংলাদেশে শিল্প ও ব্যবসা খাতের ভিত্তিতে নিম্নলিখিত বিভাগ গুলো দেখা যায়-
| ক্যাটাগরি | বর্ণনা | উদাহরণ |
| উৎপাদন (Manufacturing) | যেখানে পণ্য উৎপাদন করা হয় | গার্মেন্টস, ফার্নিচার, হস্তশিল্প |
| সেবা (Services) | যেখানে পণ্য নয়, বরং সেবা প্রদান করা হয় | হোটেল, রেস্টুরেন্ট, আইটি সার্ভিস |
| বাণিজ্য (Trading) | পণ্য কেনা-বেচার ব্যবসা | পাইকারি ও খুচরা দোকান |
| কৃষি-ভিত্তিক (Agro-based) | কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন | দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ, ফুড প্রসেসিং |
| হস্তশিল্প ও কুটির শিল্প (Cottage & Handicraft) | হাতে তৈরি পণ্য ও ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোগ | মৃৎশিল্প, বেত-খড়ের পণ্য |
| প্রযুক্তি-ভিত্তিক (Tech-based) | প্রযুক্তি নির্ভর পণ্য বা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান | সফটওয়্যার কোম্পানি, ই-কমার্স |
আরোও পড়ুনঃ বাংলাদেশের গ্রামে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করবেন কীভাবে? সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
বর্তমান সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের এসএমই খাতকে বর্তমানে একাধিক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
১. পুঁজির সংকটঃ সবচেয়ে বড় ধরনের সমস্যা হল পুঁজির সংকট। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত মূলধন পাচ্ছে না। ব্যাংক ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়েছে এবং জামানতের শর্ত কড়াকড়ি। পাশাপাশি সুদের হার অনেক ক্ষেত্রে বেশি যা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা দের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২. ডিজিটাল দক্ষতার অভাবঃ অনেক এসএমই উদ্যোক্তা অনলাইন প্লাটফর্ম ই-কমার্স ডিজিটাল মার্কেটিং এসবের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানেন না। ফলে আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অনেক পিছিয়ে পড়ছেন এসএমই উদ্যোক্তারা।
৩. কর জটিলতাঃ কর কাঠামোর জটিলতাও তাদের জন্য প্রতিবন্ধক। ভ্যাট, ট্যাক্স রিটার্ন ইত্যাদি প্রক্রিয়া অনেকেই জন্য ঝামেলা পূর্ণ। এসব প্রক্রিয়া অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে ঝামেলায় ফেলে দেয়।
৪. বাজারে প্রবেশের বাঁধাঃ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বড় বাজারে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে না। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারের রপ্তানির জন্য পর্যাপ্ত সাপোর্ট ও গাইডলাইন নেই।
৫. কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিঃ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং মুদ্রাস্ফিতির কারণে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাচ্ছে যা উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরবরাহ চেইনে সমস্যাও উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
৬. অবকাঠামো গত সীমাবদ্ধতাঃ পর্যাপ্ত গুদাম, কোল্ড স্টোরেজ এবং লজিস্টিক সুবিধা না থাকায় অনেক ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়ছে।
এছাড়াও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সামাজিক ও আর্থিক প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। যা তাদের ব্যবসা শুরু বা প্রসারিত করার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। বিদেশি ব্র্যান্ড এবং বড় কোম্পানি সাথে প্রতিযোগিতা করা এসএমই-দের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসএমই আকার ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস
নিচে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের এসএমই নীতি অনুযায়ী আকারভিত্তি শ্রেণীবিন্যাসের টেবিল তৈরি করা হয়েছে। যেখানে কর্মচারী সংখ্যা, পুঁজিবিনিয়োগ এবং বার্ষিক টার্নওভার অনুযায়ী শ্রেণী দেখানো হয়েছে-
| খাত | আকার | কর্মচারী সংখ্যা | স্থায়ী সম্পদে বিনিয়োগ (টাকা) | বার্ষিক টার্নওভার (টাকা) |
| উৎপাদন | ক্ষুদ্র (Small) | 16 – 50 জন | সর্বোচ্চ 7.5 কোটি | সর্বোচ্চ 15 কোটি |
| মাঝারি (Medium) | 51 – 120 জন | সর্বোচ্চ 30 কোটি | সর্বোচ্চ 50 কোটি | |
| সেবা | ক্ষুদ্র (Small) | 10 – 25 জন | সর্বোচ্চ 1 কোটি | সর্বোচ্চ 5 কোটি |
| মাঝারি (Medium) | 26 – 50 জন | সর্বোচ্চ 15 কোটি | সর্বোচ্চ 20 কোটি | |
| বাণিজ্য | ক্ষুদ্র (Small) | 10 – 25 জন | সর্বোচ্চ 1 কোটি | সর্বোচ্চ 5 কোটি |
| মাঝারি (Medium) | 26 – 50 জন | সর্বোচ্চ 15 কোটি | সর্বোচ্চ 20 কোটি |
আরোও পড়ুনঃ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ব্যবসায় — চ্যালেঞ্জ নাকি নতুন সুযোগ?
সরকার কি করতে পারেঃ
এসএমই ব্যবসা বাঁচাতে হলে সরকারকে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এ খাতের উন্নয়নে সরকারের করণীয় বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে।
প্রথমত, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান নিশ্চিত করা দরকার। স্বল্প সুদের ঋণ, জমানত ছাড়াই ক্রেডিট গ্যারান্টি, ডিজিটাল পেমেন্ট এর সুবিধা ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে সাহায্য করবে।
দ্বিতীয়ত, কর সুবিধা প্রদান অত্যন্ত জরুরী। কর কাঠামো সহজীকরণ করার দরকার যাতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা কর প্রদানের ক্ষেত্রে জটিলতার সম্মুখীন না হন। টেক্স হলিডে ঘোষণা এবং নির্দিষ্ট সীমার নিচে ভ্যাট মওকুফ করলে উদ্যোক্তারা স্বস্তি পাবেন।
তৃতীয়ত, ডিজিটালাইজেশন সাপোর্ট দিতে হবে। অনলাইন মার্কেটিং প্রশিক্ষণ, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং প্রযুক্তি সহায়তা এ খাতের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতা বাড়াবে। গ্রামীন পর্যায়ে ডিজিটাল মার্কেটিং সাপোর্ট সেন্টার তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি অবকাঠামো গত উন্নয়নের মাধ্যমে গুদাম, কোল্ড স্টোরেজ এবং সাপ্লাই চেইন উন্নতি করা জরুরী।
সবশেষে, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ কর ছাড় এবং লোন গ্যারান্টি স্কিম চালু করা প্রয়োজন। বড় কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এসএমই ক্লাস্টার ভিত্তিক শিল্পাঞ্চল, ইন্ডাস্ট্রিয়ার পার্ক গড়ে তোলা এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে বলা যায়, এসএমই খাতকে বাঁচানো মানে দেশের অর্থনীতিকে বাঁচানো। এসএমই খাতকে শক্তিশালী করা শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নয়, টেকসই কর্মসংস্থান এবং উদ্যোক্তা তৈরির জন্যও অত্যন্ত জরুরী। সরকার যদি সহজ শর্তে অর্থায়ন, ডিজিটাল সক্ষমতা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং কর কাঠামো সংস্কারের মত পদক্ষেপ নেয় তবে এসএমই খাত শুধু বাঁচবেই না, বরং দেশের অর্থনীতিকে আরোও শক্তিশালী করবে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরঃ
১. SME এর অর্থ কি?
উত্তরঃ SME অর্থ হলো small and medium Enterprises, বাংলায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ।
২. ডিজিটালাইজেশন কি?
উত্তরঃ ডিজিটালাইজেশন হলো প্রচলিত অ্যানালগ প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে রূপান্তর করা। যেমন; অনলাইন ব্যাংকিং, ই-কমার্স, ডিজিটাল সেবা।
৩. বাংলাদেশে এসএমই খাতে গুরুত্ব কি?
উত্তরঃ এই খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং শিল্পায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪. সরকার কিভাবে এসএমই খাতকে সহায়তা করতে পারে?
উত্তরঃ সহজ ঋণ সুবিধা, কর ছাড়, প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং রপ্তানি সহায়তা দিয়ে।
তথ্যসূত্রঃ




